রাজকোষ কেলেঙ্কারি ঘটনার তদন্তে আগামী সপ্তাহে ফিলিপাইন যাচ্ছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ-সিআইডি’র তদন্ত দল। ইতিমধ্যে আদালতের অনুমতি পেয়েছেন সিআইডি’র তদন্ত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। ফিলিপাইনে ১০ দিন অবস্থান ও দু’দিন যাতায়াত ধরে ১২ দিনের একটি ট্যুরের প্রস্তাবনা তৈরি করা হয়েছে। পুলিশ সদর দপ্তর হয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হচ্ছে এই প্রস্তাবনা। মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্ত বা জিও এবং অর্থ ছাড় হলেই ফিলিপাইনের উদ্দেশে রওনা দেবেন তারা। সিআইডি’র তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, বাংলাদেশ ব্যাংকের ৮১ মিলিয়ন ডলার চুরির ঘটনা তদন্তে ফিলিপাইন যাওয়াটা জরুরি। কারণ ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংকে গচ্ছিত ডলারগুলো কাদের কাছে গেছে তা শনাক্ত হয়ে গেছে। এখন তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করতে পারলে পুরো নেটওয়ার্কটি চিহ্নিত করা যাবে। একই সঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের কোন কর্মকর্তা এ ঘটনার সঙ্গে জড়িত রয়েছে তাও নিশ্চিত হওয়া যাবে।
Read More News
এদিকে বাংলাদেশ ব্যাংকের টাকা চুরির ঘটনায় ফিলিপাইনে শনাক্ত হওয়া ৮ ব্যক্তি ও শ্রীলঙ্কার শালিখা ফাউন্ডেশনের ছয় ব্যক্তি কখনও বাংলাদেশে এসেছিলেন কিনা তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। সিআইডি সূত্র জানায়, জড়িতরা হ্যাকিংয়ের আগে ঢাকায় এসেছিলেন বলে তারা ধারণা করছেন। এ কারণে গত দু’-বছরে তাদের বাংলাদেশে প্রবেশের বিষয়টি সম্পর্কে খোঁজ-খবর করা হচ্ছে।
রাজকোষ কেলেঙ্কারির ঘটনায় দায়ের হওয়া মামলার তদন্ত তদারক কর্মকর্তা সিআইডি’র বিশেষ পুলিশ সুপার আবদুল্লাহহেল বাকী বলেন, আমরা গুরুত্ব দিয়ে মামলাটির তদন্ত কাজ চালিয়ে যাচ্ছি। রহস্য উদ্ঘাটনে সম্ভাব্য সকল পথেই হাঁটা হচ্ছে বলে মন্তব্য করেন তিনি। সিআইডি’র অর্গানাইজড ক্রাইম ও ইকোনমিক ক্রাইম স্কোয়াডের এই কর্মকর্তা বলেন, আমরা বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে সংগৃহীত তথ্য পর্যালোচনা করছি। একই সঙ্গে ফিলিপাইনে যাওয়ারও প্রস্তুতি চলছে। যেহেতু পুরো টাকাটা ফিলিপাইনে গেছে এবং সেখানার কারা এই টাকা তুলেছে তাদের শনাক্ত করা গেছে, এজন্য তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করাটা জরুরি।
মামলার তদন্ত সূত্র জানায়, গত সপ্তাহের প্রথম কার্য দিবসে সিআইডি’র পক্ষ থেকে তদন্ত কাজের জন্য ফিলিপাইনে যাওয়ার জন্য ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতে আবেদন করা হয়। আবেদনের প্রেক্ষিতে গত সপ্তাহের শেষ কার্য দিবসে আদালত অনুমতি দেয়। অনুমতি পাওয়ার পর সিআইডি’র পক্ষ থেকে একটি প্রস্তাবনা তৈরি করা হয়েছে। আজ এই প্রস্তাবনা পুলিশ সদর দপ্তরের মাধ্যমে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হবে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় অর্থ ছাড়ের জন্য এটি অর্থ মন্ত্রণালয়ে পাঠাবে। অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে অর্থ ছাড় হলেই তদন্ত দল ফিলিপাইনে যাবে। তদন্ত সূত্র জানায়, এখন পর্যন্ত ফিলিপাইনে যাওয়ার তদন্ত দলে ৫ সদস্যের নাম রয়েছে। এর মধ্যে সিআইডি’র তিন কর্মকর্তা এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন প্রতিনিধি ও অ্যাটর্নি জেনারেল কার্যালয়ের একজন প্রতিনিধি থাকার কথা রয়েছে। সূত্র জানায়, সিআইডি’র পক্ষ থেকে ফিলিপাইনে ১০ দিন থেকে তদন্ত কাজ করার জন্য সরকারের কাছে অনুমতি চাওয়া হয়েছে। সিআইডি’র দায়িত্বশীল একজন কর্মকর্তা জানান, রিজার্ভ ব্যাংক থেকে বাংলাদেশ ব্যাংকের টাকা চুরির ঘটনাটি বড় ও স্পর্শকাতর ঘটনা। এ কারণে সেখানে অন্তত ১০ দিন অবস্থান না করলে অভিযুক্তদের জিজ্ঞাসাবাদ সম্পন্ন করা যাবে না। সিআইডি’র কর্মকর্তারা জানান, বাংলাদেশ পুলিশ টু ফিলিপাইন পুলিশ কানেকশন, আন্তর্জাতিক পুলিশ সংস্থা ইন্টারপোল এবং এশিয়া প্যাসিফিক গ্রুপ অব মানি লন্ডারিং চুক্তির আওতায় অভিযুক্তদের কাছ থেকে তথ্য আদায় করবে সিআইডি’র তদন্ত সংশ্লিষ্টরা।
সিআইডি সূত্র জানায়, বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলো থেকে ৫০ টি কম্পিউটারের ফরেনসিক পরীক্ষা ও পর্যালোচনা করা হচ্ছে। একই সঙ্গে সন্দেহভাজনদের নানাভাবে নজরদারি ও জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। এছাড়া ফিলিপাইনের সিনেটের শুনানিতে এখন পর্যন্ত ৮ জনের নাম এসেছে। তারা হলো মাইকেল ফ্রান্সিসকো ক্রুজ, জেসি ক্রিস্টোফার লাগ্রোসাস, আলফ্রেড সান্তোষ ভেরগারা, এনরিকো টিয়োডরো ভ্যাসকুয়েজ, উইলিয়াম সো গো, ক্যাম সিং ওং ওরফে কিম ওং, মায়া সান্তোস দেগুইতো ও রোমালদো আগ্রাদো। এদের কেউ গত দুই বছরে বাংলাদেশে এসেছিল কিনা ইমিগ্রেশন বিভাগ তা খতিয়ে দেখছে। একই সঙ্গে শ্রীলঙ্কার শালিকা ফাউন্ডেশনের শালিকা পেরেরা, মিয়ুরিন রানাসিংহে, প্রদীপ রোহিথা, সান্থা নালাকা ওয়ালাকুলুয়ারাচ্চি, সঞ্জিভা তিসা বান্দারা ও শিরানী ধাম্মিকা ফার্নান্দোও কখনো বাংলাদেশে এসেছিলেন কিনা তাও অনুসন্ধান করা হচ্ছে। সিআইডি’র ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা জানান, টাকা চুরির বিষয়টি দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা করে করা হয়েছে। এ কারণে হ্যাকার চক্রের সদস্যরা নাম ও পাসপোর্ট পাল্টিয়েও বাংলাদেশে আসতে পারে বলে তারা ধারণা করছেন। এজন্য অভিযুক্তদের ছবি দেখেও তাদের ঢাকায় আসার বিষয়টি নিশ্চিত হওয়ার চেষ্টা চলছে।
ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক অব নিউ ইয়র্কে সঞ্চিত বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভের অর্থ চুরির যাওয়ার ৪০ দিন পর গত ১৫ মার্চ মতিঝিল থানায় একটি মামলা দায়ের হয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষে একাউন্টস অ্যান্ড বাজেটিং ডিপার্টমেন্টের যুগ্ম পরিচালক জোবায়ের বিন হুদা বাদী হয়ে মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ এবং তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইনে মামলাটি করেন। দায়ের হওয়ার পরপরই মামলাটির তদন্তের ভার পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ- সিআইডি’র কাছে স্থানান্তর করা হয়।
ফিলিপাইনের সিনেটে তৃতীয় শুনানি আজ
বাংলাদেশের রাজকোষ কেলেঙ্কারি নিয়ে ফিলিপাইনের সিনেটে তৃতীয় শুনানি আজ। এতে মায়া সান্তোস দেগুইতো উপস্থিত নাও থাকতে পারেন। আরসিবিসি ব্যাংকের জুপিটার শাখার সাবেক এই ম্যানেজার স্বাস্থ্য সমস্যার জন্য এক সপ্তাহের অব্যাহতি চেয়েছেন সিনেট তদন্ত থেকে। এদিকে, আজকের শুনানিতেই সন্দেহভাজন ব্যবসায়ী উইলিয়াম গো ‘অধ্যায়ের সমাপ্তি’ টানার পরিকল্পনা রয়েছে বলে জানিয়েছেন সিনেটররা।
ফিলিপাইনের দৈনিক এনকোয়ারারের খবরে বলা হয়, বাংলাদেশ ব্যাংকের ৮১ মিলিয়ন ডলার পাচারের ঘটনায় সন্দেহভাজন দেগুইতো আইনজীবীর মাধ্যমে সিনেট তদন্ত থেকে এক সপ্তাহের ফুরসত চেয়েছেন। কারণ হিসেবে দেখিয়েছেন স্বাস্থ্য সমস্যা। আইনজীবী রেনে স্যাগুইস্যাগ জানিয়েছেন, দেগুইতো সিনেট ব্লু রিবন কমিটির আজকের শুনানিতে উপস্থিত নাও থাকতে পারেন। এক বিবৃতিতে স্যাগুইস্যাগ বলেছেন, ‘৯ই ফেব্রুয়ারি থেকে প্রচণ্ড চাপ ও ক্লান্তিকর এক পরিস্থিতিতে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন দেগুইতো। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়েছে, নিউ ইয়র্কের ব্যাংক থেকে আরসিবিসি ব্যাংকের প্রধান কার্যালয় ও সেখান থেকে তার জুপিটার স্টিট শাখায় ৪ বিলিয়ন পেসো স্থানান্তর ও সেখান থেকে অজ্ঞাতনামা স্থানে অর্থ চলে যাওয়ার বিষয়ে অবগত ছিলেন তিনি। এরপর থেকে একের পর এক ঘটনার মুখোমুখি তিনি। প্রথমে সাময়িকভাবে বরখাস্ত হন। পরে শাখা ব্যবস্থাপকের পদ থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়। এর আগে ব্যাংক কর্মকর্তাদের প্রশ্নবাণের মুখে পড়েন। এর কয়েক মিনিট আগে স্বামী ও ১০ বছরের সন্তানসহ জাপানগামী বিমান থেকে তাকে জোরপূর্বক নামিয়ে আনা হয়। প্রতিটি পত্রিকার প্রথম পাতায় ছাপা হয় তার ছবি। সিনেট কমিটিতে সাক্ষ্য দেয়ার জন্য তাকে তলব করা হয়। অবমাননার হুঁশিয়ারি দেয়া হয়। রুদ্ধদ্বার অধিবেশনে পরিশ্রমী ১০ সিনেটর দুই ঘণ্টা ধরে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করেন। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়েছে। মৃত্যুর হুমকিও রয়েছে। আর এখন তিনি চাকরিবিহীন, বিপর্যস্ত।’ স্যাগুইস্যাগ আরও জানান, তিনি বিবৃতিটি কমিটির সামনে পড়ে শোনাবেন।
গতকাল ফিলিপাইনের সিনেট প্রতিবেদকদের কাছে বিবৃতির কপি দেয়া হয়। ব্লু রিবন কমিটির চেয়ারম্যান সিনেটর টিওফিস্তো গুইনগোনা তৃতীয় এর কার্যালয়ের এক কর্মকর্তা নিশ্চিত করেছেন তারাও একই বিবৃতি পেয়েছেন। স্যাগুইস্যাগ আরও বলেন, ‘দেগুইতো করজোড়ে ৪ঠা এপ্রিল পর্যন্ত অব্যাহতির প্রার্থনা করছেন। ততদিনে স্বাস্থ্য ও ভারসাম্য ফিরে পাবেন বলে আশা করছেন তিনি। এরপর দায়িত্বশীলতার সঙ্গে পরবর্তী কর্মপ্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করবেন বলে তিনি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।’
কী কী থাকছে আজকের শুনানিতে: ব্লু রিবন কমিটির চেয়ারম্যান সিনেটর গুইনগোনা জানিয়েছেন, আজকের শুনানিতেই তারা উইলিয়াম সো গো অধ্যায়ের সমাপ্তি টানতে চান। এর পাশাপাশি এই অর্থ কেলেঙ্কারির ঘটনায় আরসিবিসি ব্যাংকের সংশ্লিষ্টতা নিয়েও প্রশ্ন তোলা হবে আজ। বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে আরসিবিসি ব্যাংকের কাছে লেনদেন থামানোর অনুরোধ পাঠানো সত্ত্বেও কেন তারা এই লেনদেন ঘটতে দিয়েছে, তা নিয়ে প্রশ্ন করা হবে বলে জানিয়েছেন গুইনগোনা। তিনি বলেন, ‘এই অর্থের লেনদেন অবৈধ জেনেও আরসিবিসি ব্যাংক কেন তা করতে দিয়েছে, সে বিষয়েও তাদের প্রশ্নের মুখে পড়তে হবে।’ তাছাড়া, এই অর্থ কেলেঙ্কারিতে ফিলরেমের ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন তোলা হবে বলে জানিয়েছেন তিনি। বলেন, ‘এই ঘটনায় আমাদের সবশেষ জানার বিষয় হলো ফিলরেমের ভূমিকা। আরসিবিসি ব্যাংকের অ্যাকাউন্ট থেকে সব অর্থই ফিলরেমের মাধ্যমে স্থানান্তর হয়েছে। এই ক্ষেত্রে অনেক ব্যাখ্যা দেয়ার আছে তাদের।’ দ্বিতীয় শুনানির দিন অ্যান্টি মানি লন্ডারিং অ্যাক্টের (এএমএলসি) নির্বাহী পরিচালক জুলিয়া ব্যাকায় আবাদ জানিয়েছিলেন, ফিলরেম এই লেনদেনের মাধ্যমে এএমএলসি আইন ভঙ্গ করে থাকতে পারে। সে কারণেই আরসিবিসি ও ফিলরেমের মধ্যেকার সম্পর্ক নিয়েও জানতে চাওয়া হবে বলে জানান গুইনগোনা।