২৮ বছর আগের পুরনো একটি রিট মামলাকে সচল করে বাংলাদেশের সংবিধানে রাষ্ট্রধর্ম ‘ইসলাম’ থাকবে কি থাকবে না; এই বিষয়ে হাইকোর্টে শোনানি বাতিল এবং শিক্ষা, সংস্কৃতিসহ জাতীয় পর্যায়ে ইসলামী চেতনাবোধ ধ্বংস ও নাস্তিক্যবাদি নীতি প্রতিষ্ঠার ষড়যন্ত্রের অভিযোগ এনে এসব বন্ধের দাবী জানিয়ে গতকাল (১৮ মার্চ) শুক্রবার চট্টগ্রাম হাটহাজারীতে এক বিশাল প্রতিবাদ সমাবেশ ও বিক্ষোভ মিছিল অনুষ্ঠিত হয়। সর্বস্তরের ধর্মপ্রিয় তাওহিদী জনতা’র ব্যানারে অনুষ্ঠিত প্রতিবাদ সমাবেশ ও বিক্ষোভ মিছিলে হাজার হাজার উলামা-মাশায়েখ, ছাত্র-শিক্ষক, স্থানীয় বিভিন্ন পেশাজীবির মানুষসহ লক্ষাধিক সাধারণ জনতা শরীক হন। হাটহাজারী ডাক বাংলো চত্বরে বিকেল ৩টায় শুরু হওয়া মিছিলপূর্ব সমাবেশে হেফাজতে ইসলামের কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দসহ স্থানীয় আরো বেশ কয়েকটি ইসলামী সংগঠনের নেতৃবৃন্দ সংবিধান থেকে রাষ্ট্রধর্ম বাতিলের জন্যে মামলা দায়েরসহ যে কোন ষড়যন্ত্র ও উদ্যোগের তীব্র প্রতিবাদ এবং ষড়যন্ত্রকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর আন্দোলন গড়ে তোলার হুঁশিয়ারী দিয়ে বক্তব্য রাখেন। বাদ আছর সমাবেশ শেষে এক বিশাল বিক্ষোভ মিছিল বের হয়। মিছিলটি ডাক বাংলো চত্বর থেকে বের হয়ে চট্টগ্রাম-খাগড়াছড়ি সড়ক, হাটহাজারী বাস স্ট্যান্ড, চট্টগ্রাম-রাঙ্গামাটি সড়ক ও কাচারী সড়ক হয়ে পুণরায় ডাক বাংলো চত্বরে এসে শেষ হয়।
হাটহাজারী পৌর হেফাজতের সভাপতি মাওলানা মীর ইদরিস এর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত প্রতিবাদ সমাবেশে প্রধান অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখেন, হেফাজতে ইসলামের মহাসচিব ও দারুল উলূম হাটহাজারী মাদ্রাসার প্রখ্যাত মুহাদ্দিস আল্লামা হাফেজ মুহাম্মদ জুনায়েদ বাবুনগরী। আরো বক্তব্য রাখেন হেফাজতে ইসলামের কেন্দ্রীয় যুগ্মমহাসচিব মাওলানা মুঈনুদ্দীন রুহি, সাংগঠনিক সম্পাদক মাওলানা আজিজুল হক ইসলামাবাদি, মুফতী ফখরুল ইসলাম-ঢাকা, মাওলানা আবু আহমদ, মাওলানা আনাস মাদানী, মাওলানা আবু তৈয়ব আব্দুল্লাপুরী, মাওলানা কাজী সফি উল্লাহ, মুফতী শেহাব উদ্দীন, মাওলানা জাহাঙ্গীর আলম, মাওলানা হাবীবুল হক বাবু, আলহাজ্ব আব্দুর রহমান চৌধুরী, মাওলানা মাহমুদ হোসাইন, মাওলানা জাকারিয়া নোমান, মাওলানা আব্দুল ওয়াদুদ নোমানী, মাওলানা ইমরান সিকদার, সেলিম উদ্দীন রেজা, মাস্টার শফিউল আলম, এসএম ফারুক প্রমুখ। প্রতিবাদ সমাবেশ পরিচালনা করেন, সর্বস্তরের ধর্মপ্রিয় তাওহিদী জনতা’র সমন্বয়ক মাওলানা কাজী সফি উল্লাহ ও মাওলানা কামরুল ইসলাম।
Read More News
মিছিল পূর্ব সমাবেশে প্রধান অতিথির বক্তব্যে হেফাজতে ইসলামের কেন্দ্রীয় মহাসচিব আল্লামা হাফেজ মুহাম্মদ জুনায়েদ বাবুনগরী বলেন, সংবিধান থেকে রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম বাতিলের ষড়যন্ত্র দেশবাসী বরদাস্ত করবে না। ৯২ ভাগ মুসলমানের দেশে রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম থাকবে কি থাকবে না, এ নিয়ে আদালতে মামলা ও শোনানি চলতে পারে না। সরকারকেই এই মামলা বাতিলের জন্যে উদ্যোগি হওয়ার আহ্বান জানিয়ে হেফাজত মহাসচিব বলেন, জনগণের মনের ভাষা বুঝার চেষ্টা করুন। ইসলামের বিধি-বিধান ও মানুষের ধর্মীয় বিশ্বাস নিয়ে আদালত রুল বা আদেশ জারির এখতিয়ার রাখতে পারে না। রাষ্ট্রধর্ম নিয়ে দেশবাসীর আক্বিদা-বিশ্বাসের বিরুদ্ধে যদি কোন রায় আসে, আল্লাহর কসম, সে দিন এদেশের সাড়ে চার লক্ষ মসজিদ থেকে কোটি কোটি মুসলমানের প্রতিবাদের দাবানল জ্বলে ওঠে ষড়যন্ত্রকারীদের চক্রান্তকে চারখার করে দেবে।
তিনি বলেন, নাস্তিক্যবাদিরা বর্তমান ধর্মনিরপেক্ষ সরকারের ঘাড়ে সাওয়ার হয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতা, অর্থসম্পদ ও জনগণের ধর্মীয় আক্বিদা-বিশ্বাস লুটপাট ও ধ্বংস করার গভীর ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছে। ইতিপূর্বে ৯২ ভাগ মুসলমানের এই দেশের সংবিধান থেকে মহান আল্লাহর উপর আস্থা ও বিশ্বাসের ধারা মুছে দিয়ে ধর্মনিরপেক্ষ নীতি সংযোজন করা হয়েছে, বিসমিল্লাহর ভুল অর্থ সংবিধানে লেখা হয়েছে, জাতীয় শিক্ষানীতি থেকে ইসলামী নীতি-আদর্শ ও চেতনাবোধকে বাদ দেওয়া হয়েছে। সংস্কৃতিসহ সর্বক্ষেত্রে এখন ইসলাম বিরোধীতা, মুসলমানদেরকে হেয় করা এবং ইসলামী চেতনাবোধ মুছে ফেলার জোর অপতৎপরতা চলছে। বাংলাদেশের অর্থসম্পদ নিয়ে লুটপাট চলছে। ঈমান-আক্বিদা ও ধর্মীয় আদর্শকেও লুটে নিয়ে নাস্তিক্যবাদ ও ভোগবাদিতা প্রতিষ্ঠা করার জোর ষড়যন্ত্র চালানো হচ্ছে। এটা কোনভাবেই আর চলতে দেওয়া যায় না, চলতে দেওয়া হবে না।
হেফাজত মহাসচিব সরকারকে সতর্ক করে দিয়ে বলেন, দেশে আইন-শৃঙ্খলা ও সুশাসন প্রতিষ্ঠা করুন, দেশের সম্পদের লুটপাট বন্ধ করুন এবং ধর্মের উপর একের পর এক আঘাত দেওয়ার অপতৎপরতা থামান। জনগণের মনের ভাষা বুঝার চেষ্টা করুন। অন্যথায় মানুষের ক্ষোভের দাবানল জ্বলে ওঠলে ষড়যন্ত্রকারীদের কেউই পালানোর পথ খুঁজে পাবে না।
তিনি বলেন, বাংলাদেশে ৯২ ভাগ মুসলমান যেমন স্বাধীন ধর্মীয় ও নাগরিক অধিকার নিয়ে বসবাস করবে, তেমনি হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রীস্টানসহ সকল অমুসলিমরাও নাগরিক ও তাদের ধর্মীয় অধিকার নিয়ে বসবাস করবে। আমরা চাই মুসলমানদের পাশাপাশি অন্যান্য সকল ধর্মাবলম্বীও যেন এদেশে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির সাথে সুখে শান্তিতে বসবাস করে। যারা সংবিধান থেকে রাষ্ট্রধর্ম মুছে দিতে চায়, তারা মূলতঃ এদেশে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বাঁধাতে চায়। এরা দেশে ও জনগণের দুশমন। দেশ ও জাতির এই দুশমনদেরকে উৎখাত করার জন্যে আমরা আজ ঐক্যবদ্ধ।
হেফাজত মহাসচিব আরো বলেন, বর্তমান সংবিধানে রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম রাখার পাশাপাশি হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রীস্টানসহ অন্যান্য সকল ধর্মাবলম্বীর মর্যাদা ও অধিকারের কথাও স্পষ্টভাবে লেখা হয়েছে। সুতরাং সংবিধান থেকে রাষ্ট্রধর্ম বাতিলের অর্থই হচ্ছে সাংবিধানিকভাবে নাস্তিক্যবাদ প্রতিষ্ঠা। এই প্রতিবাদে অমুসলিমদেরও শামিল হওয়া চাই। তিনি রাষ্ট্রধর্ম নিয়ে ষড়যন্ত্রকারীদেরকে হুঁশিয়ারী দিয়ে বলেন, আগুন নিয়ে খেলা করবেন না। পুড়ে ছারখার হয়ে যাবেন।
প্রতিবাদ সমাবেশে হেফাজতে ইসলামের যুগ্মমহাসচিব মাওলানা মুঈনুদ্দীন রুহি বলেন, দেশের শান্তি-শৃঙ্খলার স্বার্থে এদেশের উলামা-মাশায়েখ ও তৌহিদী জনতা নাস্তিক্যবাদিদের নানা ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে ধৈর্যের সাথে শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ করে যাচ্ছেন। ষড়যন্ত্রকারীরা এটাকে দুর্বলতা বা নিষ্ক্রিয়তা ভাবলে চরম ভুল করবে। তাদের বুঝা উচিত, মুসলমান নিজের প্রাণের চেয়েও আল্লাহ-রাসূল ও ঈমান-ইসলামের মর্যাদা রক্ষাকে অধিক মূল্য দিয়ে থাকে। তিনি বলেন, সংবিধানের প্রথম পরিচ্ছদের ২-ক অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম, তবে হিন্দু, বৌদ্ধ খ্রীস্টানসহ অন্যান্য ধর্ম পালনে রাষ্ট্র সমমর্যাদা ও সমঅধিকার নিশ্চিত করিবেন’। এরপরও রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম বাতিলের প্রশ্ন তোলার মানেই হচ্ছে, সংবিধানিকভাবে এদেশে নাস্তিক্যবাদ প্রতিষ্ঠা ছাড়া আর কিছু নয়। তিনি হুঁশিয়ারী উচ্চারণ করে বলেন, রাষ্ট্রীয়ভাবে নাস্তিক্যবাদ প্রতিষ্ঠার যে কোন উদ্যোগ মুসলমানগণ বুকের তাজা রক্ত দিয়ে হলেও প্রতিহত করবে, ইনশাআল্লাহ।
হেফাজতে ইসলামের সাংগঠনিক সম্পাদক মাওলানা আজিজুল হক ইসলামাবাদি বলেন, রাষ্ট্রধর্ম বাতিলের মতো কোন হঠকারি সিদ্ধান্ত কেউ নিতে চাইলে সে দিন বাংলাদেশের সকল মসজিদ থেকে কোটি কোটি মুসলমান রাস্তায় বেরিয়ে ষড়যন্ত্রকারীদের উচ্ছেদ করা ছাড়া ঘরে ফিরে যাবে না, ইনশাআল্লাহ। তিনি বলেন, ৯১ ভাগ মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ বাংলাদেশে গত অর্ধযুগ থেকে একের পর এক ইসলাম ও মুসলিম চেতনা-বিশ্বাসকে যেভাবে কোণঠাসা করা হচ্ছে, তাতে এটা এখন আর কারো বুঝতে বাকী নেই যে, দেশবাসীর ঘাড়ে নাস্তিক্যবাদি অপশক্তি চেপে বসতে চাইছে। জনগণের ধর্মীয় বিশ্বাস ও আদর্শ বিরোধী ২৮ বছর আগের চরম বিতর্কিত ও পরিত্যক্ত একটি মামলাকে হঠাৎ সচল করে সংবিধানে রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম থাকবে কি থাকবে না, এর উপর হাইকোর্টের শোনানি গ্রহণের সিদ্ধান্তে দেশের উলামা-মাশায়েখ ও কোটি কোটি তাওহীদি জনতা চরমভাবে বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেছে। মাওলানা আজিজুল হক ইসলামাবাদি আরো বলেন, যেখানে গত বছরের ৭ সেপ্টেম্বর সংবিধানে রাষ্ট্রধর্ম ইসলামকে বহাল রাখার বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে আইনজীবি সোমেন্দ্রনাথ গোস্বামির দায়ের করা রিট হাইকোর্ট সরাসরি খারেজ করে দিয়েছে, মাত্র ৫ মাসের মাথায় একই বিষয়ে ২৮ বছরের পুরনো একটি মামলা পুণরায় সচল করার মানে কি? এদেশের মুসলমানদের ধর্মীয় বিশ্বাস ও আদর্শের বিরুদ্ধে এটা গভীর ষড়যন্ত্র ছাড়া আর কিছু নয়।
হাটহাজারী পৌর হেফাজতের সভাপতি মাওলানা মীর ইদরিস সরকারের প্রতি কোন অদৃশ্য অপশক্তির চাপে নয়, বরং দেশের গণমানুষের প্রত্যাশা মতো রাষ্ট্র পরিচালনার আহ্বান জানিয়ে বলেন, হুমকি-ধমকী ও ভীতি প্রদর্শনের মাধ্যমে মানুষকে চুপ রাখার নীতি পরিহার করে গণমানুষের মনের ভাষা বুঝার চেষ্টা করুন। নাগরিক অধিকার প্রতিষ্ঠা করুন এবং দেশের বৃহৎ মুসলিম জনগোষ্ঠীর ধর্মীয় মতাদর্শ নিয়ে নাস্তিক্যবাদিদের সকল ষড়যন্ত্র নস্যাত করুন।
গতকাল বাদ জুমা হাটহাজারী সদর ও তার পার্শ্ববর্তী বিভিন্ন এলাকা থেকে হাজার হাজার তৌহিদী জনতা খ- খ- মিছিল নিয়ে ডাকবাংলো চত্বরসহ সামনের চট্টগ্রাম-খাগড়াছড়ি মহাসড়কে জমায়েত হয়। এ সময় হাটহাজারী-খাগড়াছড়ি এবং হাটহাজারী-রাঙ্গামাটি মহাসড়কসহ সমগ্র হাটহাজারী এলাকা তৌহিদী জনতার পদভারে এবং শ্লোগানে শ্লোগানে প্রকম্পিত হয়ে ওঠে। বিকেল ৩টায় প্রতিবাদ সমাবেশ শুরু হলে ৫টা পর্যন্ত নেতৃবৃন্দ বক্তব্য রাখেন। এরপর বাদ আছর হাটহাজারী ডাকবাংলো থেকে প্রতিবাদি লাখো তৌহিদী জনতা ব্যানার, ফেস্টুন ও প্লাকার্ড হাতে শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ মিছিল শুরু হয়। মিছিলটি ডাক বাংলো থেকে শুরু হয়ে চট্টগ্রাম-খাগড়াছড়ি মহাসড়ক, হাটহাজারী বাসস্ট্যান্ড ও হাটহাজারী-রাঙ্গামাটি মহাসড়ক ও কাছারি সড়ক হয়ে পুণরায় ডাক বাংলো চত্বরে এসে শেষ হয়। মিছিলের সময় হাজার হাজার মানুষকে ফুটপাথ, ভবনের ছাদ, গাড়ী ও বিভিন্ন বাসাবাড়ীর জানালা দিয়ে হাত নেড়ে মিছিলকারীদের প্রতি সমর্থ জানাতে দেখা যায়। এরপর খন্ড খন্ড মিছিল নিয়ে তৌহিদী জনতা যার যার অবস্থানে ফিরে যায়।
মিছিল পূর্ব সমাবেশে পরবর্তী কর্মসূচী কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ সম্মিলিতভাবে পরামর্শের মাধ্যমে নির্ধারণ করে অল্পদিনের মধ্যেই সাংবাদিক সম্মেলন করে জানানো হবে বলে ঘোষণা দেওয়া হয়।