ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে দেশের বিভিন্ন জেলা উপজেলার প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ছে নির্বাচন পরবর্তী সংঘাত ও সহিংসতা। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে জানিয়েও কোনো লাভ হচ্ছে না বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। কোনো কোনো এলাকায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের সামনেই ঘটছে এসব ঘটনা। কিন্তু সহিংসতা ঠেকাতে তারা ব্যর্থ হচ্ছে। বিশেষ করে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে জয়ী ও পরাজিত প্রার্থীদের কর্মী-সমর্থকরাই এসব ঘটাচ্ছে। বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে গাড়ির রেলিংয়ের সঙ্গে বেঁধে নির্যাতন করার অভিযোগ পাওয়া গেছে।
এদিকে নির্বাচন পরবর্তী সময়ে গতকাল মাদারীপুর, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, নাটোর, কুষ্টিয়াসহ বিভিন্নস্থানে ব্যাপক গোলাগুলি, ভাঙচুর, অগি্নসংযোগ, মারামারিসহ নানা ধরনের সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে। এসব সহিংসতায় গুলিবিদ্ধের সংখ্যা আতঙ্কজনক। বলা চলে নির্বাচন পরবর্তী এই সহিংসতায় বৈধ ও অবৈধ অস্ত্রের ঝনঝনানি ক্রমেই বাড়ছে।
Read More News
আমাদের মাদারীপুর প্রতিনিধি জানান, মাদারীপুরের নির্বাচন পরবর্তী সহিংসতায় সাতজন গুলিবিদ্ধ হয়েছেন বলে জানা গেছে। গতকাল শুক্রবার সকালে মাদারীপুর সদরের কুনিয়া ইউনিয়নের আদিত্যপুর গ্রামে এ ঘটনা ঘটে। সদর মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) জিয়াউল মোর্শেদ বিষয়টি নিশ্চিত করেন। গুলিবিদ্ধরা হলেন হাসান (৩০), রাকিব (১৮), আলতাজ (২৬), রুবেল (২৩), নাঈম (১৭), কামাল (৩৫) ও আবুল কালাম। আহতদের ফরিদপুর ও ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে।
স্থানীয় সূত্র জানান, দ্বিতীয় দফার ইউপি নির্বাচনে স্বতন্ত্র চেয়ারম্যান প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে পরাজিত হন সাহেব আলী। এর আগে এই নির্বাচনে সাহেব আলীকে সমর্থন দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন এলাকার সাবেক চেয়ারম্যান ইসমাইল মাস্টার। কিন্তু প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী সহায়তা না করায় সাহেব আলীর পরাজয় ঘটে বলে সমর্থকদের অভিযোগ। এরই জের ধরে দুই পক্ষের মধ্যে সশস্ত্র সংঘর্ষ ঘটে। এ সময় ৭ জন গুলিবিদ্ধ হন।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া প্রতিনিধি তফাজ্জল হোসেন জানান, ইউপি নির্বাচনকে কেন্দ্র করে নির্বাচন পরবর্তী সহিংসতায় গতকাল শুক্রবার ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আশুগঞ্জ ও নবীনগরে পৃথক সংঘর্ষে কমপক্ষে ৬০ জন আহত হয়েছে। এসময় গুলিবিদ্ধ হয় বেশ কয়েকজন। সংঘর্ষে উভয় পক্ষের বাড়িঘর, দোকানপাট ভাঙচুর, অগি্নসংযোগ ও লুটপাটের ঘটনা ঘটে। পুলিশ ৫ জন দাঙ্গাবাজকে আটক করেছে। জানা যায়, গত ২২ মার্চ প্রথম দফায় ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে দুর্গাপুর গ্রামের আ’লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী মোয়াজ্জেম হোসেন মাজু মিয়ার সাথে আ’লীগ মনোনীত প্রার্থী জিয়াউল করিম খান সাজুর সমর্থকদের বিরোধ চলছিল। নির্বাচনে আ’লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী পরাজিত হলে এ উত্তেজনা বেড়ে যায়। এর জের ধরে গতকাল শুক্রবার সকালে দুর্গাপুর ইউনিয়নের তাজপুরে ও পরে দুর্গাপুরে দু’পক্ষের সমর্থকরা দেশীয় অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়। দু’গ্রামের কয়েক হাজার দাঙ্গাবাজ অন্তত ৭টি স্পটে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়লে পুরো এলাকা রণক্ষেত্রে পরিণত হয়।
দুপুর ১টায় আশুগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সন্দ্বীপ কুমার সিংহ, আশুগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মোহাম্মদ সেলিম উদ্দিনসহ র্যাব ও অতিরিক্ত পুলিশ গিয়ে সংঘর্ষ নিয়ন্ত্রণ করে। আহতরা গ্রেফতার আতংকে জেলার বিভিন্ন প্রাইভেট ক্লিনিকে চিকিৎসা ও ভর্তি হন। সংঘর্ষ নিয়ন্ত্রণে পুলিশ ও র্যাব অন্তত ৫০ রাউন্ড টিয়ার সেল ও রাবার বুলেট নিক্ষেপ করে। সংঘর্ষে বেশকিছু দোকানপাট, বাড়িঘরে অগি্নসংযোগ, লুটপাটের ঘটনা ঘটে।
এদিকে জেলার নবীনগর উপজেলার বীরগাঁও ইউনিয়নে গতকাল সকালে আ’লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী বিজয়ী চেয়ারম্যান কবির আহম্মেদ ও পরাজিত চেয়ারম্যান কবির হোসেনের (স্বতন্ত্র) সমর্থকদের মধ্যে ভোট দেয়া নিয়ে সংঘর্ষে ১০ জন আহত হয়। সংঘর্ষের সময় গুলিবিদ্ধ জিল্লুর রহমান (৬০) ও ঝানু মিয়া (৫০)কে আশংকাজনক অবস্থায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে প্রেরণ করা হয়। এছাড়া আহত আলাল মিয়া, আরমান মিয়া, রাহুল, রবিউল আওয়াল, সুদন মিয়া, ডা. সাদেক মিয়া, কানু মিয়াকে নবীনগর সদর হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।
নাটোর প্রতিনিধি জানান, নাটোরের লালপুরে বিজয়ী ইউপি সদস্য প্রার্থীর সমর্থকরা পরাজিত প্রার্থীর সমর্থকদের ১০ বাড়িতে ভাঙচুর, অগি্নসংযোগ ও লুটপাটের ঘটনা ঘটিয়েছে। এসময় অন্তত ১০ জন আহত হয়েছেন। গতকাল শুক্রবার সকাল ১০টায় উপজেলার লালপুর ইউনিয়নের বাকনাই এবং খাঁ পাড়া গ্রামে এ ঘটনা ঘটে।
ক্ষতিগ্রস্তরা জানান, বৃহস্পতিবার লালপুর সদর ইউনিয়নের ২নং ওয়ার্ডের বাকনাই কেন্দ্রে আধিপত্য বিস্তার নিয়ে দুই সদস্য প্রার্থী ইউসুফ ও হান্নানের সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষ হয়। সংঘর্ষে উভয়পক্ষের অন্তত ১০ জন আহত হয়। নির্বাচনে সদস্য প্রার্থী ইউসুফ হোসেন বিজয়ী হলে ঐ ঘটনার জের ধরে গতকাল শুক্রবার সকালে তার সমর্থকরা পরাজিত প্রার্থী হান্নানের সমর্থকদের বাড়িতে হামলা চালিয়ে ১০টি বাড়িতে অগি্নসংযোগ করে। এসময় ৩০টি বাড়িতে এবং দোকানপাটে ব্যাপক ভাঙচুর চালায়। এছাড়া বাড়িঘরের নগদ টাকা, গরু-ছাগলসহ আসবাবপত্র লুট করে নিয়ে যায় দুর্বত্তরা। এ ঘটনায় আহত ১০ জনকে লালপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেঙ্ েভর্তি করা হয়েছে।
আমাদের কুষ্টিয়া প্রতিনিধি জানান, কুষ্টিয়ার দৌলতপুরে নির্বাচন পরবর্তী সংঘর্ষে ৫ জন আহত হয়েছেন। গতকাল শুক্রবার দুপুরে উপজেলার হোসেনাবাদ বাজারে এ ঘটনা ঘটে।
পুলিশ ও স্থানীয়রা জানায়, স্থানীয় হোসেনাবাদ বাজারের নবনির্বাচিত ইউপি সদস্য দুলাল মেম্বর সকালে হোসেনাবাদ বাজারে আসলে নির্বাচনে পরাজিত ইউপি সদস্য প্রার্থী ঝন্টু ও মনিরুল তার ওপর হামলা চালায়। এসময় উভয়পক্ষের মধ্যে ইট-পাটকেল নিক্ষেপ ও ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। সংঘর্ষ চলাকালে হামলাকারীরা সড়কে গাছের গুড়ি ফেলে কুষ্টিয়া-প্রাগপুর-মহিষকু-ি সড়ক প্রায় ১ ঘণ্টা অবরোধ করে। সংঘর্ষের খবর পেয়ে দৌলতপুর থানা পুলিশ ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়ে ৩ রাউন্ড গুলিবর্ষণ করে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করে। এ ঘটনায় ইশারত সর্দার (৩৮) নামে একজনকে আটক করে পুলিশ।
এদিকে বৃহস্পতিবার রাতে উপজেলার মরিচা ইউনিয়নের বৈরাগীরচর গ্রামে পরাজিত ইউপি সদস্য মোস্তফার নেতেৃত্বে ১৫-১৬ জনের একটি দল প্রতিপক্ষ জামসেদ আলী, আতর আলী, বাদল মিস্ত্রি, সাইদুর ও জিয়ার বাড়িতে হামলা করে। এসময় ৫ জন আহত হন। আহতদের মধ্যে আব্দুর রাজ্জাক (৩২) ও টিপুকে (৩৫) দৌলতপুর হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। খবর পেয়ে পুলিশ ঘটনাস্থলে পৌঁছে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করে।
ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে উৎসবের আমেজে বিষাদ ছড়িয়েছে রক্তপাত। প্রথম ভোটার হয়েছেন যারা তাদের কাছে ভোট মানেই উৎসব নয়, পরিণত হয়েছে আতঙ্কে। ইউনিয়ন পরিষদের প্রথম ধাপের নির্বাচনে একদিনে দেশব্যাপী ঝরেছে ১১টি তাজা প্রাণ।
আর গত বৃহস্পতিবার দ্বিতীয় দফা ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ও এক নারীসহ ৬ জেলায় ১০ জন নিহত হয়েছেন। হামলা, গুলি, বোমা, ধারালো অস্ত্রের আঘাতসহ নানাভাবে আহত হয়েছেন শ্রীবরদীর ইউএনওসহ ৪ শতাধিক মানুষ।