বিশেষ এক জাতের পুরুষ মাছিকেই ড্রোন বলা হয়। বিশাল চোখ ও হুল ফোটানোর মতা রয়েছে এসব মাছির। এই মাছির ‘ভোঁ-ভোঁ’ করা থেকেই ‘ড্রোন’ শব্দটি এসেছে। বর্তমানে ড্রোন শব্দটি শুনলেই সবাই আঁতকে উঠি। ড্রোন হলো পাইলটবিহীন একটি উড়ন্ত যান। সাম্প্রতিক সময়ে বিশ্বব্যাপী তথ্যপ্রযুক্তির উৎকর্ষতা সাধনের মাধ্যমে ড্রোনের নানাবিধ ব্যবহার বা গ্রহণযোগ্যতা ধীরে ধীরে বাড়ছে। যুগের সাথে তাল মিলিয়ে বর্তমানে দেশে সরকারি বা বেসরকারি
বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণ বিজ্ঞানীরা আন্তর্জাতিক মানের ড্রোন তৈরি করছেন। সাম্প্রতিক সময়ে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে ড্রোনের পরীামূলক
উড্ডয়ন এবং এর সমতা যাচাইয়ের জন্য উড্ডয়ন কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। লিখেছেন আহমেদ ইফতেখার
Read More News
২০০১ সালের ভয়ঙ্কর নাইন-ইলেভেনের পরপরই ড্রোনের কার্যক্রম সম্প্রসারিত হয়। প্রথমবারের মতো ২০০২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে আফগানিস্তানে ড্রোনের মাধ্যমে সামরিক শক্তি প্রয়োগ করে তিনজনকে হত্যা করা হয়েছে বলে পেন্টাগন স্বীকার করে। পরবর্তীকালে আফগানিস্তান, ইরাক, পাকিস্তান, সিরিয়া প্রভৃতি দেশে দূরনিয়ন্ত্রিত ড্রোন দিয়ে সন্ত্রাসীচক্রের ঘাঁটির ওপর আঘাত করা হয়েছে বারবার। বর্তমানে ড্রোন প্রযুক্তি এমন একটি অবস্থানে পৌঁছেছে, যার মাধ্যমে সে তার কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স (এআই টেকনোলজি) প্রয়োগ করে শত্রু বা শত্রুঘাঁটি বা পূর্বনির্ধারিত যেকোনো ল্যবস্তুর ওপর সংযোজিত মারণাস্ত্র প্রয়োগ বা ল্যবস্তুর ইমেজ বা ছবি সংগ্রহ করা যাচ্ছে।
সুইডেনভিত্তিক ইন্টারন্যাশনাল পিস রিসার্চ ইনস্টিটিউটের জরিপ মতে, ব্রিটেন সবচেয়ে বেশি ড্রোন আমদানি করে থাকে এবং ড্রোন রফতানির শীর্ষে রয়েছে ইসরাইল। সম্প্রতি চীন সন্ত্রাসবাদ মোকাবেলায় কিছু স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র পরিচালনাকারী ড্রোন নাইজেরিয়ায় রফতানি করেছে। জাতিসঙ্ঘের মানবাধিকার সংস্থা এ ড্রোনের বিষয়ে তাদের গতানুগতিক উদ্বেগ প্রকাশ করেছে।
মানবকল্যাণে ড্রোন
সন্ত্রাসবাদ মোকাবেলায় উন্নত রাষ্ট্রগুলো ড্রোন ব্যবহারে যেমন অগ্রসর, তেমনি নানারকম মানবকল্যাণমূলক কর্মকাণ্ডেও ড্রোন ব্যবহার করা হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র এই ড্রোনকে মানবকল্যাণ বা সামাজিক কাজে সম্পৃক্ত করার েেত্র অনেকটা অগ্রসর। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পুলিশ ফায়ার ব্রিগেড, বিদ্যুৎ টাওয়ার পর্যবেণকারী কর্তৃপ ড্রোন ব্যবহারে বহুধাপ এগিয়ে। বিশ্বের সর্বোচ্চ অনলাইন রিটেলার ‘আমাজান’ ইতোমধ্যে ড্রোন ব্যবহারের মাধ্যমে দ্রুতগতিতে প্যাকেজ ডেলিভারি দেয়ার সমতা অর্জন করেছে। বিদ্যুৎ লাইন ও টাওয়ার পর্যবেণে ড্রোন অত্যন্ত নিরাপদ ও সাশ্রয়ী। জার্মানিতে কয়েক বছর ধরেই দমকল ড্রোন ব্যবহার করছে। তারা বিশেষ ইনফ্রারেড ক্যামেরা নিয়ে আকাশ থেকে নিখোঁজ মানুষের খোঁজ করে। বিপজ্জনক এলাকায় গিয়েও ছবি তুলতে পারে এই যন্ত্র। জার্মানির বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ড্রোন প্রযুক্তির উন্নতির কাজ চলছে। যেমন ইলমেনাউয়ের গবেষকেরা এমন এক কোয়াড্রোকপ্টার তৈরির উদ্যোগ নিয়েছেন, যা মোবাইল টাওয়ার মেরামত করতে পারবে। ‘ডিপ ড্রোন ৮০০০’ নামের এই যন্ত্র উড়তে পারে না বটে, কিন্তু তাতে কী এসে যায়! সংজ্ঞা অনুযায়ী ড্রোন মানববিহীন হলেই চলবে। অর্থাৎ ড্রোন ডুবুরিও হতে পারে। মার্কিন নৌ-বাহিনীর তৈরি এই ড্রোন ২,৫০০ মিটার গভীরে গিয়ে ডুবোজাহাজ উদ্ধারে সাহায্য করতে পারে।
সাধারণত দুই ধরনের ড্রোন বাজারে পাওয়া যায়Ñ একটি ফিক্সড উইং রোটর, যা উড্ডয়নের জন্য দীর্ঘ রাস্তার প্রয়োজন হয় এবং অপরটি হলো মাল্টিরোটর উইং, যা যেকোনো স্থান থেকে উড্ডয়ন সম্ভব।
ড্রোন নিয়ে উদ্বেগ
সংশ্লিষ্ট কর্তৃপরে অনুমতি ছাড়াই দেশে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে ড্রোন তৈরি হচ্ছে। এসব ড্রোন ব্যবহারের মাধ্যমে বিভিন্ন স্পর্শকাতর স্থাপনায় ড্রোনের সাহায্যে আকস্মিকভাবে বড় ধরনের নাশকতা বা দুর্ঘটনা ঘটানোর আশঙ্কা করছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। কেপিআই নিরাপত্তা নীতিমালা-২০১৩ অনুসারে বিশেষ শ্রেণীর কেপিআইগুলোকে (বঙ্গভবন, গণভবন ও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়) নো ফাইং জোন হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। ইতোমধ্যে ঢাকা ও চট্টগ্রাম বিমানবন্দরে বেশ কিছু অবৈধ ড্রোন আটক করা হয়েছে। প্রযুক্তিগতভাবে দ দেশীয় জঙ্গি সংগঠনগুলোর মধ্যে ড্রোন তৈরি বা সংগ্রহ করার অপচেষ্টা এবং বর্তমানে সারা বিশ্বে জঙ্গি বা সন্ত্রাসীগোষ্ঠীর ড্রোন হামলা বা নাশকতা চালানোর বিভিন্ন পদ্ধতি বা পন্থাগুলো রপ্ত করা ও ব্যবহারে উদ্বুদ্ধ হওয়ার আশঙ্কা থেকে যায়, যা জাতীয় নিরাপত্তার স্বার্থে অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ।
ঘাতক ড্রোন
বর্তমানে এমকিউ-৯ মডেলের ড্রোনকে ভয়ঙ্কর ঘাতক বলে আখ্যায়িত করা হয়। এটি ১৪ ঘণ্টা একনাগাড়ে আকাশে প্রয়োজনীয় মারণাস্ত্রসহ উড়তে পারে, যা ২২০০ কিলোগ্রাম পর্যন্ত ওজন বহন করতে সম। সর্বোচ্চ ৫০ হাজার ফুট উচ্চতায় এই ড্রোন চালনা সম্ভব, যা ঘণ্টায় ৩৫০ মাইল বেগে চলতে পারে। এই ঘাতক ড্রোনটি তৈরি করতে প্রায় ৫৪ মিলিয়ন ডলার ব্যয় হয়, যার মধ্যে প্রয়োজনীয় ইনফ্রারেড এবং জিপিএস সংযোজিত ও নির্ধারিত অস্ত্রশস্ত্র লোডিং অবস্থায় থাকে। পাইলট ড্রোনটি সঠিকভাবে উড্ডয়নের জন্য দায়িত্বশীল থাকেন এবং অন্যজন ড্রোনের সব সেন্সর তথা ইনফ্রারেড, নাইটভিশন ক্যামেরা ইত্যাদি সঠিকভাবে পরিচালনা করেন। আধুনিক প্রযুক্তিসমৃদ্ধ মানববিহীন (ইউএভি) ড্রোন মধ্য আকাশেই নিয়ন্ত্রণ পরিবর্তন করা যায়, অর্থাৎ ইরাকের সামরিক ঘাঁটি থেকে উড্ডয়নের পর মধ্য আকাশেই ক্যালিফোর্নিয়ার সামরিক ঘাঁটির অন্য আরেকটি টিম নিয়ন্ত্রণ করে তা টেকঅন বা ল্যান্ডিং করাতে সম। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রযুক্তির বিকাশ ঘটিয়ে ড্রোন তৈরিতে অনেক ধাপ এগিয়ে। এমনকি দেশটি নিউকিয়ার বোমা বহনকারী ড্রোন তৈরিতে অনেক দূর এগিয়েছে।
ড্রোন ব্যবহারের নীতিমালা
সাম্প্রতিক সময়ে বিভিন্ন আকারের ড্রোন ব্যবহার বৃদ্ধি পাওয়ায় ফেডারেল এভিয়েশন অ্যাডমিনিস্ট্রেশন একটি নীতিমালা প্রণয়ন করেছে, যা অভ্যন্তরীণ ড্রোন পরিচালনার জন্য প্রযোজ্য। নীতিমালাটি ২.৫ পাউন্ড ওজন থেকে ৫৫ পাউন্ড ওজন পর্যন্ত ড্রোনের েেত্র প্রযোজ্য বলে উল্লেখ করা হয়েছে। বলা হয়েছে, এই ওজন পরিসীমার একটি ড্রোন পরিচালনাকারীকে নলেজ টেস্টে উত্তীর্ণ হতে হবে; তবে ব্যবহারিক পরীা দিতে হবে না।
ড্রোন উড্ডয়নের জন্য সর্বনি¤œ ১৭ বছর বয়স হতে হবে। এসব ড্রোনের উড্ডয়ন শুধু দিনের আলোয় সর্বোচ্চ ৫০০ ফুট উচ্চতায় এবং ঘণ্টায় ১০০ মাইল গতিবেগে সীমাবদ্ধ থাকতে হবে। বিমানবন্দর, অস্থায়ী ল্যান্ডিং জোন এবং জনাকীর্ণ স্থানে ড্রোন ব্যবহারে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। প্রতিটি ড্রোন ক্রয়ের পর গাড়ির রেজিস্ট্রেশনের মতো নিবন্ধন করতে হবে এবং রেজিস্ট্রেশন নম্বরটি ড্রোনের দর্শনীয় স্থানে লিপিবদ্ধ করে রাখার জন্য নীতিমালায় উল্লেখ করা হয়েছে।
ড্রোনের বাণিজ্যিক ব্যবহার যত বাড়ছে, ততই বাড়ছে দুর্ঘটনার সংখ্যা। মুক্ত আকাশে উড়তে গিয়ে প্রায়ই আকাশচারী প্রাণীর সাথে সংঘর্ষ হচ্ছে ড্রোনের। এমন সংঘর্ষের ফলে প্রাণীকুলের বিপদ বাড়ছে, চলাচলেও অসুবিধা হচ্ছে। এ থেকে মুক্তির উপায় খুঁজে বের করার চেষ্টা করেছেন দুই অস্ট্রেলীয় গবেষক। কিভাবে ড্রোন ওড়ালে প্রাণীকুলের জন্য বিপদের কারণ হবে না, তারই একটি নীতিমালা প্রণয়ন করেছেন তারা। কারেন্ট বায়োলজি জার্নালে প্রকাশিত এই নীতিমালা প্রণয়ন করেছেন অস্ট্রেলিয়ার ইউনিভার্সিটি অব অ্যাডিলেডের আনম্যানড রিসার্চ এয়ারক্রাফট ফ্যাসিলিটির (ইউআরএএফ) গবেষক জ্যারোড হজসন এবং ইউআরএএফের পরিচালক লিয়ান পিন কোহ।
বন্যপ্রাণী পর্যবেণে ড্রোনের ব্যবহার জরুরি, তবে কাছাকাছি অভয়ারণ্য থাকলে কিংবা চলার পথে কোনো প্রাণী পড়ে গেলে সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নেয়ার পরামর্শ দেয়া হয়েছে এই নীতিমালায়।
বাংলাদেশে ড্রোন
বাংলাদেশেও ড্রোন নিয়ে ছাত্রছাত্রী ও সাধারণের আগ্রহ লণীয়। আমাদের মনে রাখতে হবে, ড্রোন শুধু সামরিক কাজেই নয়, বিভিন্ন জনকল্যাণমূলক কাজে এর ব্যবহার ক্রমেই বাড়ছে। বাংলাদেশের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগপূর্ণ দেশে ঘূর্ণিঝড়পূর্ব প্রস্তুতি ও পুনর্বাসন, ফায়ার ব্রিগেড, পুলিশ, র্যাব, বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইন পর্যবেণ, বহুতল ভবনের নিরাপত্তা, বিমানবন্দরের নিরাপত্তা, সমুদ্রসৈকতে পর্যটকদের নিরাপত্তা ইত্যাদি বহুবিধ কাজে বিভিন্ন সরকারি সংস্থা এই প্রযুক্তিকে ব্যবহার করতে পারে। ড্রোন কোনো মাদকদ্রব্য নয় যে, একে নিষিদ্ধ করতে হবে।