আজ সোমবার বিচারপতি জে বি এম হাসান ও বিচারপতি খায়রুল আলমের বেঞ্চে এক বছর ধরে বাবা-মায়ের ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত দুই শিশুর আর্তনাদের মামলার শুনানি অনুষ্ঠিত হয়।
আম্মু, আমরা তোমাদের দুজনকে চাই। তোমরা এক সাথে হয়ে যাও। না হলে আমরা তোমাদের কারো কাছে থাকব না।
দুই বিচারপতির সামনে মাকে জড়িয়ে ধরে চিৎকার করে কাঁদতে কাঁদতে এমনিভাবে আকুতি জানায় শিশু সালিম সাদমান ধ্রুব (১২) ছোট ভাই সাকিব সাদমান লুব্ধক (৯)।
এ সময় ধ্রুব তার বাবার দিকে হাত বাড়িয়ে ডাকতে থাকে, ‘বাবা তুমি এদিকে এসো। আম্মুকে সরি বলো। আমরা আর কিছু চাই না। তোমাদের একত্রে দেখতে চাই।’
দুই ছেলের আকুতি-মিনতি ও কান্নায় হাইকোর্টের বিচারকক্ষে আবেগঘন পরিবেশ সৃষ্টি হয়। দুই শিশুর কান্না শুনে ওই কক্ষে ভিড় জমায় শত শত আইনজীবী ও গণমাধ্যমকর্মী। সবার চোখে তখন কান্নার দৃশ্য। দেখে মনে হয়, কোনো বাংলা ছায়াছবির দৃশ্য।
তখন এক বিচারপতি কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলতে থাকেন, আজকের বিচার করবে এ দুই শিশু। আজকে তারা যে সিদ্ধান্ত দেবে সেটাই হবে রায়।
অবশেষে মন গলে বাবা-মায়ের। একপর্যায়ে বিচারপতিরা বাবা-মা দুইজনের সঙ্গে খাস কামরায় গিয়ে কথা বলেন। তাদের উভয়ের ও শিশুদের বক্তব্য শুনেন। এর পরই মনোমালিন্যের কারণে বিবাহ বিচ্ছেদে যাওয়া বাবা-মাকে একত্রে ফিরে পায় দুই শিশু।
মামলার বিবরণে জানা যায়, দুই শিশুর মা কামরুন্নাহার মল্লিকা রাজশাহীর মেয়ে। পড়তেন ঢাকা গার্হস্থ্য অর্থনীতি কলেজে। বাবা মিয়া মো. মেহেদী হাসান, মাগুরার ছেলে। পড়ালেখা করেছেন ঢাকা কলেজে। পড়ালেখা অবস্থায় দুজনের পরিচয়। পরিচয় থেকে প্রেম। এরপর ২০০২ সালে বিয়ে হয় তাঁদের। একপর্যায়ে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে মনোমালিন্য ঘটে। ২০১৭ সালের ১২ মে তাঁদের বিবাহ বিচ্ছেদ হয়। স্বামী মেহেদী হাসান স্ত্রীকে তালাক দেওয়ার এক সপ্তাহ আগে দুটি সন্তানকে গ্রামের বাড়ি মাগুরায় পাঠিয়ে দেন। বোনের তত্ত্বাবধানে মাগুরার জেলা শহরের একটি স্কুলে ভর্তি করিয়ে দেওয়া হয়। এক বছর মা-সন্তানদের মধ্যে কোনো দেখা-সাক্ষাৎ হয়নি।
শেষ পর্যন্ত সন্তানদের নিজের হেফাজতে নেওয়ার জন্য হাইকোর্টের শরণাপন্ন হন। এজন্য নির্দেশনা চেয়ে হাইকোর্টে রিট দায়ের করলে গত ২৯ মে আদালত শিশু দুটিকে হাইকোর্টে হাজির করতে সংশ্লিষ্ট পুলিশ ও শিশু দুটির বাবাকে নির্দেশ দেন। ২৫ জুন তাদের হাজির করতে বলা হয়। একই সঙ্গে সন্তানকে কেন মায়ের হেফাজতে দেওয়া হবে না, তা জানতে চেয়ে রুল জারি করেন।
সেই নির্দেশ মোতাবেক শিশু দুটিকে আজ আদালতে হাজির করে পুলিশ। এ ছাড়া শিশু দুটির বাবা-মা, মামা, নানি ও ফুপুসহ আত্মীয়স্বজনরা আদালতে হাজির হন।
আদালত আদেশে বলেন, আগামী ৪ জুলাই পর্যন্ত শিশু সন্তান দুটি মায়ের হেফাজতে থাকবে। তবে এই সময়ে বাবা শিশু দুটির দেখাশোনা করার অবারিত সুযোগ পাবেন।
৪ জুলাই পরবর্তী দিন ঠিক করে সেদিন শিশু দুটিকে হাজির করার নির্দেশ দিয়ে বিষয়টি মুলতবি করেন। একইসঙ্গে শিশুদের নিয়ে ঘুরতে যাওয়া এবং পর্যাপ্ত পরিমাণ সময় দেওয়ার জন্য বাবা-মাকে নির্দেশ দেন।
রায়ের পর আদালত দুই শিশুকে কাছে ডেকে নিয়ে বলেন, তোমরা আবার আসবে। ওই দিন আমাদের জানাবে, তোমাদের বাবা-মা তোমাদের সঙ্গে কেমন আচরণ করে। ভালো থেক।
এ সময় ছোট ছেলে সাকিব সাদমান বিচারককে বলতে থাকে, ‘আংকেল আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।’
আদালতে শিশু দুটির বাবার পক্ষে ছিলেন আইনজীবী তাপস বল। মায়ের পক্ষে ব্যারিস্টার রুহুল কুদ্দুস কাজল। সঙ্গে ছিলেন এ কে এম রিয়াদ সলিমুল্লাহ।
আদেশের পর শিশুদের বাবা মেহেদী হাসান বলেন, ‘অতীতে কী হয়েছে তা চিন্তা করছি না। এ মুহূর্তে আমার দুই সন্তানের চাওয়াটাই আমার চাওয়া।’
পাশে দাঁড়িয়ে থাকা শিশুদের মা কামরুন্নাহার মল্লিকাও বলতে থাকেন, ‘এ মুহূর্তে আমি সবচেয়ে বেশি খুশি। আমার সন্তানদের কাছে পেয়েছি, এটাই আমার সবচেয়ে বড় পাওয়া। দোয়া করবেন আমাদের জন্য।’
এ সময় দুই শিশুই বারবার বাবা-মায়ের হাত ধরে এক সঙ্গে হাঁটতে থাকে।