৪৫০ কোটি টাকার রপ্তানি হুমকির মুখে

বাংলাদেশি পণ্যবাহী কার্গো বিমান সরাসরি যুক্তরাজ্যে চলাচলের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারিতে হুমকির মধ্যে পড়েছে সাড়ে চারশ’ কোটি টাকার কাঁচা পণ্যের রপ্তানি। এ নিষেধাজ্ঞার কারণে শঙ্কা দেখা দিয়েছে পুরো রপ্তানি খাতে। যুক্তরাজ্যের পথে ইউরোপীয় ইউনিয়ভুক্ত অন্য দেশও হাঁটলে পরিস্থিতি আরও জটিল আকার ধারণ করতে পারে বলে মনে করছেন রপ্তানি খাত সংশ্লিষ্টরা। এজন্য এখনই প্রয়োজনীয় সরকারি পদক্ষেপ নেয়ার দাবি জানিয়েছেন তারা। রপ্তানি খাত সংশ্লিষ্টরা জানান, তৈরি পোশাকসহ অপচনশীল পণ্য বিকল্প পথে সরবরাহের সুযোগ থাকলেও সবজি, ফল ও মাছ রপ্তানিতে ভয়াবহ সংকট সৃষ্টি হবে। সবজি ও ফল রপ্তানির বড় বাজার যুক্তরাজ্য। এছাড়া দেশি মাছ ও চিংড়ি রপ্তানি হয় দেশটিতে। এ বাজার হারালে রপ্তানির জাতীয় আয়ে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। আর এর প্রভাব যাত্রীবাহী বিমানেও পড়বে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। বাংলাদেশ ফ্রুটস, ভেজিটেবল অ্যান্ড অ্যালাইড প্রডাক্টস এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন সূত্রে জানা যায়, গত অর্থবছরে এসব পণ্যে রপ্তানি আয় হয়েছে ১৪ কোটি ১৬ লাখ ডলার (বাংলাদেশি মুদ্রায় ১,১৩২ কোটি টাকা)। এর মধ্যে শুধু যুক্তরাজ্যের বাজার থেকেই আয় হয় ৪০ শতাংশ বা ৪০০ কোটি টাকা। বর্তমানে দেশের প্রায় ২০০টি প্রতিষ্ঠান ৭০ থেকে ৮০ ধরনের সবজি ও ফল যুক্তরাজ্যের বাজারে রপ্তানি করছে। বাংলাদেশ থেকে বিমানে প্রতিদিন গড়ে ৩০ থেকে ৪০ টন এ পণ্য যুক্তরাজ্যে যায়। আকাশপথে পণ্য পাঠানোর সুযোগ না থাকলে রপ্তানিতে ধস নামবে। কারণ অন্য পণ্যের মতো পচনশীল পণ্য সমুদ্র পথে পাঠানোর সুযোগ খুবই কম।
অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি এস এম জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, গত বৃহস্পতিবার পর্যন্ত কিছু পরিমাণে রপ্তানি হয়েছে। শুক্রবার থেকে সবজি ও ফল রপ্তানি পুরোপুরি বন্ধ রয়েছে। নিষেধাজ্ঞা স্থায়ী হলে এ বাজার হারাতে হবে। তবে বিদেশি বিভিন্ন এয়ারলাইন্সের সঙ্গে আলোচনা চলছে। তাদের ট্রানজিট পয়েন্টে স্ক্যান করে সবজি ও ফল যুক্তরাজ্যে পাঠানো যেতে পারে। কিন্তু চুক্তি অনুযায়ী পণ্য পাঠানো না গেলে ক্রেতারা অন্য দেশ থেকে পণ্য আমদানি করবে। আর আমদানিকারকরা একবার অন্য দেশে প্রবেশ করলে ভবিষ্যতেও আমাদের বাজার কমে আসবে। রপ্তানির বাজারে প্রতিযোগিতা বেড়ে যাবে। এর আগে একই রকম ঘোষণায় পণ্য পরিবহন স্থগিত করে অস্ট্রেলিয়া। সে সময় সরকারিভাবে এটি সমাধানের আশ্বাস দেয়া হলেও, উন্নতি নেই খুব একটা। এমন অবস্থায় দুশ্চিন্তা বাড়িয়েছে ব্যবসায়ীদের। তাই তাদের মতে, এখনই নিরাপত্তা ইস্যুতে বাংলাদেশের অবস্থান জোরালো না হলে, নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে পুরো রপ্তানি খাতে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, গত মাস দুয়েক আগে বিমান ও সিভিল এভিয়েশন কর্তৃপক্ষকে নোটিশ দেয় যুক্তরাষ্ট্রের সিভিল এভিয়েশন নিরাপত্তা পরিদর্শক দল। দুই দফা নোটিশের পর স্ক্যানিং পদ্ধতির কোনো অগ্রগতি দেখতে পায়নি যুক্তরাজ্যের পরিদর্শক দল। ফলে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে দেশটি। এ ছাড়া অব্যবস্থাপনা, চোরাচালান আর নিরাপত্তা ইস্যুতে নানা সময়ে আলোচনায় শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর। একই সঙ্গে, সেবার মান আর লাভ-লোকসানের কারণে আলোচনার কেন্দ্রে রাষ্ট্রীয় সংস্থা বিমান বাংলাদেশ। বাংলাদেশ থেকে সরাসরি যুক্তরাজ্যে একমাত্র পণ্য পরিবহন বা কার্গো সেবাটিও দখলে ছিল বিমানের। তাই এর কার্যক্রম নিয়েও প্রশ্ন নানা মহলে।
বাংলাদেশ ফ্রেইট ফরোয়ার্ডার্স অ্যাসোসিয়েশন (বাফা) ও বিমান সূত্রে জানা যায়, বাংলাদেশ থেকে ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে কৃষিপণ্য রপ্তানি হয়েছে- জার্মানিতে ৫০৮ কোটি বা ১৬.২১%, যুক্তরাজ্যে ৩০২ কোটি বা ৯.৬৬%, ফ্রান্সে ১৯১ কোটি বা ৬.১২%, স্পেনে ১৫৮ কোটি বা ৫.০৮%, ইতালিতে ১২০ কোটি বা ৩.৮৩%, নেদারল্যান্ডে ৮৪ কোটি বা ২.৭০%, বেলজিয়াম ৮৩ কোটি বা ২.৬৬% ও তুরস্কে ৮৩ কোটি বা ২.৬৫% ডলার। সূত্র জানায় ,বাংলাদেশ থেকে বিমান পথে বাৎসরিক কার্গো রপ্তানি প্রবৃদ্ধি ১০ থেকে ১৫ শতাংশ। বিভিন্ন দেশে এই পথে প্রতি বছর ১ লাখ ৫০ হাজার থেকে ২ লাখ ৫০ হাজার মিলিয়ন টন কার্গো রপ্তানি হয়। বাংলাদেশ থেকে রপ্তানি হয়- গাজর, টমেটো, আলু, বেগুন, শাক, ফুলকপি, পেঁপে, কুমড়া, কাঁচামরিচ, বরবটি, শিম, লাউ, পটল, কচু, লতি, বাঁধাকপি, ধনে পাতা, শসা, করলা, শিম, পাটশাক, সজনে, মূলা, শুঁটকি মাছ এবং মাংস। এ ছাড়া লেবু, আমড়া, চালতা, আম, কাঁঠালসহ নানা জাতের ৭০ থেকে ৮০টি মৌসুমি ফল যুক্তরাজ্যে রপ্তানি হয়। অন্য দিকে অনেকেই যুক্তরাজ্যে কৃষি প্রক্রিয়াজাত প্যাকেটজাত খাদ্য রপ্তানি করে থাকে।
বিজিএমইএ সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান বলেন, যুক্তরাজ্যে আমাদের কার্গো বিমান সরাসরি যেতে পারবে না, এটা আমাদের ইমেজের জন্য বিরাট বাধা হয়ে দাঁড়াবে। তিনি বলেন, এই রকম যদি চলতে থাকে তাহলে ২০২১ সালের মধ্যে রপ্তানির লক্ষ্যমাত্রা ৫০০ কোটি ডলারে যাওয়া তো দূরে থাক, বিদ্যমান বাজার ধরে রাখাই কঠিন হয়ে যাবে।
Read More News

বিজিএমএই ও রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্যে দেখা যায়, গত ২০১৪-১৫ অর্থবছরে যুক্তরাজ্যে বাংলাদেশ থেকে ৩০০ কোটি ডলারের পোশাক রপ্তানি হয়। যা ওই সময়ের মোট পোশাক রপ্তানির ১১.৩৯ শতাংশ। চলতি অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে এই বাজারে প্রায় ২০০ কোটি ডলারের পোশাক রপ্তানি হয়েছে, যা গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ২৬.১০ শতাংশ বেশি।
বিজিএমইএর সভাপতি বলেন, এই পরিসংখ্যানই বলে দিচ্ছে যুক্তরাজ্যের বাজার বাংলাদেশের জন্য কতটা গুরুত্বপূর্ণ। এই বাজারে কোনো রকম নেতিবাচক প্রভাব পড়ুক তা কাম্য নয়। সভাপতি বলেন, মোট রপ্তানির প্রায় ১০ থেকে ১৫ শতাংশ পণ্য প্রতি বছর উড়োজাহাজে পাঠাতে হয়।
অ্যাসোসিয়েশন অব ট্রাভেল এজেন্টস অব বাংলাদেশের (আটাব) নেতা কাজী এম এ করিম বেলাল বলেন, যাত্রীদের মধ্যে অনেক বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে। যাত্রীরা যুক্তরাজ্যে যেতে পারবে কি না তা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করছে।
গত বৃহস্পতিবার সচিবালয়ে ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠকের পর সাংবাদিকদের বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ বলেন, যুক্তরাজ্যে বাংলাদেশের কার্গো বিমান অবতরণে নিষেধাজ্ঞার সময় আরও বাড়লে আমরা অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবো। আমাদের বেশির ভাগ পণ্য কার্গো বিমানে যুক্তরাজ্য যায়। তবে শিগগিরই নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করা হবে বলে আশা করছি।
এর আগে বেসামরিক বিমান ও পর্যটনমন্ত্রী রাশেদ খান মেনন সাংবাদিকদের বলেছিলেন, তাদের প্রস্তাব অনুযায়ী নিরাপত্তার ব্যাপারে একসঙ্গে কাজ করতে সম্মত হয়েছি। তারা যে প্রস্তাব দিয়েছে সে ব্যাপারে ব্যবস্থা নিয়েছি। আমি আশা করি ৩১শে মার্চের আগেই সুরাহা হয়ে যাবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *