ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের প্রভাব বাড়ছে। অন্যদিকে দলটির প্রধান প্রতিপক্ষ বিএনপি দৃশ্যত আরো পিছিয়ে পড়ছে। বিএনপি ব্যাকফুটে চলে গেছে আর এর নেত্রী খালেদা জিয়া নাশকতা ও রাষ্ট্রদ্রোহ মামলায় দোষী সাব্যস্ত হলে তাঁর দীর্ঘ মেয়াদে কারাদণ্ড হতে পারে এবং তিনি রাজনীতি থেকে ছিটকে পড়তে পারেন। ২০১৫ সালের শুরু থেকে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও নিরাপত্তা সম্পর্কিত বিভিন্ন ঘটনা পর্যালোচনা করে গত বুধবার প্রকাশিত ব্রিটিশ পার্লামেন্টের এক প্রতিবেদনে এসব কথা বলা হয়েছে। ব্রিটিশ পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষ হাউস অব কমন্স প্রকাশিত প্রতিবেদন সম্পর্কে ভূমিকায় বলা হয়েছে, পার্লামেন্টের সদস্য ও তাঁদের স্টাফদের নিরপেক্ষভাবে বিভিন্ন দেশের পরিস্থিতি জানানোর অংশ হিসেবে বাংলাদেশ বিষয়ে এ প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়েছে। এটি ‘কমন্স ব্রিফিং পেপার’ নামে পরিচিত। প্রতিবেদনের একটি অংশে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার বড় ছেলে ও দলের সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমান প্রসঙ্গে বলা হয়েছে, ‘তিনি লন্ডনে আছেন এবং সেখানেই তিনি রাজনৈতিক আশ্রয় চাচ্ছেন।’ তারেক প্রসঙ্গে আরো বলা হয়েছে, তাঁর বিরুদ্ধে দুর্নীতি ও রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা রয়েছে। ভবিষ্যতে কোনো একদিন বিএনপিতে তিনি তাঁর মায়ের উত্তরাধিকারী হওয়ার আশা ধরে রেখেছেন। ব্রিটিশ প্রতিবেদনের ‘সারমর্ম’ অংশে বলা হয়েছে, বিএনপি ব্যাকফুটে চলে গেছে। দলটি ২০১৪ সালের জানুয়ারি মাসে নির্বাচন বর্জন করে। নির্বাচনী ব্যবস্থার বিরুদ্ধে ধর্মঘট ও অবরোধের মাসগুলো পার করে ২০১৫ সালে দলটির আন্দোলন মরে গেছে। প্রতিবেদনে বলা হয়, “২০১৫ সালের শুরুর দিকে পৌরসভা নির্বাচন বর্জনের পরও দলটি গত ডিসেম্বরে এ ধরনের নির্বাচনে অংশ নিয়ে খারাপ ফল পায়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের মধ্যে ২০১৯ সালের সংসদ নির্বাচনের আগে রাজনৈতিক সুবিধা কাজে লাগানোর সংকল্প দেখা যাচ্ছে। সমালোচকরা সরকারের বিরুদ্ধে ‘ক্রমেই কর্তৃত্বপরায়ণ হয়ে ওঠার’ অভিযোগ করছে। কিন্তু সরকার তা নাকচ করছে।” ‘বিএনপি ব্যাকফুটে’—এমন পর্যবেক্ষণ শুধু ব্রিটিশ প্রতিবেদনটির সারমর্মতেই নয়, মূল প্রতিবেদনের একটি অনুচ্ছেদের শিরোনামেও বলা হয়েছে। ওই অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে বিএনপির আন্দোলন ২০১৫ সালে ক্রমান্বয়ে স্তিমিত হয়ে আসে। আর এটিকেই খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক পরাজয় হিসেবে ব্যাপকভাবে ব্যাখ্যা করা হয়। আন্দোলনের সময় শতাধিক ব্যক্তি নিহত হয়েছে। দি ইকনোমিস্ট বিএনপিকে ‘পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে সাড়া দিতে অক্ষম’ দল হিসেবে বর্ণনা করেছে। ‘কৌশল পরিবর্তন?’ শিরোনামে এক অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, দুর্নীতির অভিযোগের মুখোমুখি খালেদা জিয়া ২০১৫ সালে প্রায়ই সংলাপের প্রয়োজনীয়তার কথা বলেছেন। পরবর্তী সংসদীয় নির্বাচন দুই বছর এগিয়ে আনার দাবিও তিনি তুলতে শুরু করেছিলেন। ২০১৯ সালে পরবর্তী নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা। যত দ্রুত সম্ভব নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নতুন সংসদ নির্বাচনের যে দাবি বিএনপি করছে তা মানা হলে দলটি তার অবস্থানে ছাড় দিতে পারে বলে জল্পনা-কল্পনা রয়েছে। তবে এ দাবি পূরণের সম্ভাবনা বাস্তবে অনেক দূরে। সরকার বিভিন্ন সময় সংলাপের জন্য প্রস্তুত থাকার কথা বললেও নির্বাচনকালীন পুরনো সরকার ব্যবস্থা (তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা) পুনর্বহাল করার আগ্রহের কোনো লক্ষণ দেখায়নি। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিএনপি গত ডিসেম্বর মাসের শেষ দিকে দেশজুড়ে পৌরসভা নির্বাচন বর্জন করতে পারে বলেও জল্পনা-কল্পনা ছিল। তবে নির্বাচন অবাধ বা সুষ্ঠু হবে না—এমন দাবি করেও বিএনপি শেষ পর্যন্ত এতে অংশ নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। আওয়ামী লীগ ওই নির্বাচনে তিন-চতুর্থাংশ পদে জয়ী হয়। ‘খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে অভিযোগ’ শীর্ষক অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, বাসে হামলায় একজন নিহত ও ২৭ জন আহত হওয়ার ঘটনার মামলায় গত বছর মে মাসে খালেদা জিয়া ও বিএনপির আরো ৩৭ নেতার বিরুদ্ধে হত্যাচেষ্টা ও অগ্নিসংযোগের অভিযোগ আনা হয়েছে। এটি খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে প্রথম আনুষ্ঠানিক অভিযোগ, যেখানে দুর্নীতির অভিযোগ নেই। এই অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে গত ৩০ মার্চ খালেদা জিয়া ও অন্য নেতাদের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা হয়েছে। গত বছর এপ্রিল মাসে খালেদা জিয়া দুর্নীতির অভিযোগ সম্পর্কিত এক মামলায় জামিন পেয়েছেন। গত বছরের আগস্ট মাসে তাঁর কয়েকটি মামলার বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে আইনজীবীর দায়ের করা মামলা হাইকোর্ট খারিজ করে দিয়ে মামলা চলার পক্ষে রায় দেন। মৃত্যুদণ্ডাদেশ পাওয়া জামায়াতে ইসলামীর একজন জ্যেষ্ঠ রাজনীতিকও খালেদা জিয়ার সঙ্গে মামলার আসামি। খালেদা জিয়া জামিনে মুক্ত আছেন। তবে তাঁর বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলাও আছে। এসব অভিযোগে দোষী সাব্যস্ত হলে তিনি দীর্ঘ মেয়াদে কারাদণ্ড পেতে পারেন এবং রাজনীতির বাইরে ছিটকে পড়তে পারেন। গত মার্চ মাসে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া ইঙ্গিত দেন যে শেখ হাসিনা আগামী সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী হতে পারবেন না। এর প্রতিক্রিয়ায় শেখ হাসিনা দাবি করেন, তাঁকে খালেদা জিয়া হত্যার ষড়যন্ত্র করছেন। প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘১৯৭১ সালে পাকিস্তানের কাছ থেকে স্বাধীনতা অর্জনের যুদ্ধের সময় মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য দায়ীদের বিচার করতে আওয়ামী লীগ সরকারের গঠন করা আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল কাজ করছেন। ২০১৫ সালে বিএনপির একজন ও জামায়াতে ইসলামীর শীর্ষস্থানীয় দুই নেতার ফাঁসি কার্যকর করা হয়েছে। সরকারের প্রতিপক্ষ বলে আসছেন যে এ বিচার রাজনৈতিকভাবে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। বিচারগুলো আন্তর্জাতিক মানের হচ্ছে না—এমনটিও তাঁরা অব্যাহতভাবে বলছেন।’ প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, ইসলামী সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলোর ক্রমবর্ধমান ঝুঁকি ঘিরে উদ্বেগ ছিল। ২০১৫ সালে চারজন ধর্মনিরপেক্ষ ব্লগার ও একজন প্রকাশককে ঢাকায় হত্যা করা হয়েছে। বিদেশিরাও হামলার শিকার হচ্ছে। গত বছরের অক্টোবর মাসে দুজনকে হত্যা করা হয়েছে। এসব ঘটনায় বাংলাদেশ সরকার দেশি জঙ্গিগোষ্ঠীগুলোকে দায়ী করেছে এবং দেশে আইএসের পদচিহ্ন পড়ার ভাবনা নাকচ করে দিয়েছে। বাংলাদেশের বৈদেশিক সম্পর্ক বিষয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১৫ সাল ছিল বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ এক বছর। গত বছরের জুন মাসে দুই দেশ ছিটমহল বিনিময় ও সীমান্ত চিহ্নিতকরণ প্রক্রিয়া চূড়ান্ত করার সিদ্ধান্ত নেওয়ার মাধ্যমে অনেক দিন ধরে চলে আসা সীমান্ত বিরোধ নিষ্পত্তি করেছে। বিশদ পরিসরে আরো অনেক বিষয়েও দুই দেশ চুক্তিতে উপনীত হয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা ও শেখ হাসিনার সরকারের জনপ্রিয়তা অটুট থাকার তথ্য জনমত জরিপগুলোতে এলেও বিএনপি সেগুলোর বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে চ্যালেঞ্জ করছে। সমালোচকরা অভিযোগ করেছেন, শেখ হাসিনার সরকারের কর্তৃত্ববাদ বাড়ছে। এ সরকার ‘এক ব্যক্তির শাসন’ উৎসাহিত করছে। মানবাধিকার গোষ্ঠীগুলো দাবি করেছে, গণমাধ্যমগুলো কর্তৃপক্ষের চাপে আছে এবং নিরাপত্তা বাহিনীগুলো বিশেষ করে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন সরকারের রাজনৈতিক বিরোধীদের ‘গুম’ ও বিচারবহির্ভূত হত্যায় জড়িত। সরকার এসব দাবি পুরোপুরি নাকচ করেছে। প্রতিবেদনের আরেকটি অংশে বলা হয়েছে, ভারত তার দেশে জেএমবির ক্রমবর্ধমান উপস্থিতিতে উদ্বেগ জানিয়েছে। ‘বৃহত্তর বাংলা’র ভাবনার প্রতি সহানুভূতিশীলরা সেখানে আছে, এমনটি বলা হচ্ছে। ২০১৫ সালে দুই ব্লগার হত্যায় সম্পৃক্ততার অভিযোগে বাংলাদেশ গত বছরের আগস্ট মাসে তৌহিদুর রহমান নামে ৫৮ বছর বয়সী এক ব্রিটিশ নাগরিককে গ্রেপ্তার করেছে। যুক্তরাজ্যে উগ্রবাদ মোকাবিলায় আরো ব্যবস্থা নিতে বাংলাদেশ সরকার গত সপ্তাহে ব্রিটিশ সরকারকে আহ্বান জানিয়েছে। নিউ ইয়র্কে ফেডারেল রিজার্ভ থেকে বাংলাদেশ ব্যাংকের ১০১ মিলিয়ন মার্কিন ডলার লোপাটের ঘটনায় গত মার্চ মাসে ব্যাংকের গভর্নর ড. আতিউর রহমানের পদত্যাগের বিষয়টিও প্রতিবেদনে উল্লেখ রয়েছে। বলা হয়েছে, এ ঘটনাকে ইতিহাসের সবচেয়ে বড় ব্যাংক ডাকাতি বলেই মনে করা হয়।
Read More News